1. admin@amaderchannel.online : admin :
  2. 2193wenona@powerscrews.com : rakib boss : rakib boss
  3. nnsabiha@gmail.com : SABIHA AKTER : SABIHA AKTER
রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:৫৮ অপরাহ্ন
আজ ২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ১৬ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি , ৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

হৃদয়-রাজ্যের কৈফিয়ত: এক বিচারকের চাবুক এবং হারুন অর রশিদের কান্না – আশরাফুল আলম তাজ

  • Update Time : শনিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২৫
  • ৮১ Time View

 

হৃদয়-রাজ্যের কৈফিয়ত: এক বিচারকের চাবুক এবং হারুন অর রশিদের কান্না – আশরাফুল আলম তাজ

প্রবন্ধঃ মানবসত্তা ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক এক নিগূঢ় বন্ধন; যেখানে শাসনযন্ত্রের মূল কর্তব্য কেবল আইন প্রতিষ্ঠা নয়, বরং মানবিকতার নির্যাস সিঞ্চন। ন্যায়বিচারের আসনে যখন প্রজ্ঞা, করুণা ও আত্মোপলব্ধি মিলিত হয়, তখনই জন্ম নেয় প্রকৃত ‘সুবিচার’—যা কেবল অপরাধীর দণ্ডবিধান করে না, বরং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা ব্যাধিগুলিকে চিহ্নিত করে। খলিফা হারুন অর রশিদের স্বর্ণযুগের এই উপাখ্যানটি তেমনই এক কালোত্তীর্ণ মহাকাব্য, যেখানে শাসনতান্ত্রিক ব্যর্থতার দায় শোষিতের উপর না চাপিয়ে, শাসকশ্রেণি নিজেদের হাতেই দণ্ড গ্রহণ করে।

অন্ধ আইনের ভার ও মানবতার আর্তনাদ

গল্পের সূচনা হয় এক অন্ধকার সত্যের উন্মোচনে। অনাহারে শীর্ণ, নিরুপায় এক বৃদ্ধা, তাঁর দুই এতিম নাতির ক্ষুধার্ত মুখচ্ছবি সহ্য করতে না পেরে, চুরি করে বসেন রুটি আর মধু। আইনের চোখে এটি নিঃসন্দেহে দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু বিচারকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কেবল ‘অপরাধ’ দেখেনি, তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সেই ‘অপরাধের জন্মদাত্রী
পরিস্থিতিকে’।

জীর্ণ দেহে বৃদ্ধার সেই অকপট স্বীকারোক্তি: “আমার কাছে এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না,” যেন সভ্য সমাজের প্রতি এক নীরব অভিযোগ, এক হৃদয়বিদারক কৈফিয়ত। এই স্বীকারোক্তি ছিল যেন প্রকৃতির সেই অলঙ্ঘনীয় বিধানের প্রতিফলন, যেখানে ক্ষুধা নামের আদিমতম প্রয়োজন সকল সামাজিক বাঁধনকে ছাপিয়ে যায়।

গল্পের চিত্রায়ণ: ন্যায়ালয়ের মঞ্চে এক করুণ আলেখ্য
খলিফার প্রেরিত বিচারকের অধীনে বিচারকাজ শুরু হওয়ার পরই প্রহরীরা সেই বৃদ্ধাকে দরবারে হাজির করলেন। রুটি ও মধু চুরির অপরাধে ধৃত বৃদ্ধার সঙ্গে বিচারকের কথোপকথন ছিল মর্মস্পর্শী:

বিচারক: আপনি চুরি করেছেন?

বৃদ্ধা: (মাথা নিচু করে) জি।

বিচারক: আপনি কি জানেন না চুরি করা কত বড় পাপ?

বৃদ্ধা: জানি।

বিচারক: জেনেও কেন চুরি করলেন?

বৃদ্ধা: কারণ আমি গত এক সপ্তাহ যাবত অনাহারে ছিলাম। আমার সাথে এতিম দুই নাতিও না খেয়ে ছিল। আমি ওদের ক্ষুধার্ত চেহারা এবং কান্না সহ্য করতে পারিনি, তাই চুরি করেছি। আমার কাছে এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।

বৃদ্ধার এই হৃদয়বিদারক সত্য শোনামাত্র বিচারক এজলাসের সবাইকে পরদিন উপস্থিত থাকার নির্দেশ দিলেন। পরদিন রায় ঘোষণার সময় তিনি প্রথমে কঠোর দণ্ড ঘোষণা করলেন: “বৃদ্ধা মহিলার চুরির অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ১ বছর কারাদণ্ড, ৫০টি চাবুক এবং ১০০ দিনার অর্থদণ্ড প্রদান করা হলো। তবে অকপটে সত্য বলার কারণে কারাদণ্ডের সাজা মাফ করা হলো।”

এরপরই ঘটে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বিচারক নিচে নেমে বৃদ্ধার পাশে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন: “যে নগরে একজন ক্ষুধার্ত বৃদ্ধ মহিলা না খেতে পেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় চুরি করতে বাধ্য হয়, সেখানে তো সবচেয়ে বড় অপরাধী সে দেশের খলিফা। আর আমি এসেছি খলিফার প্রতিনিধি হয়ে। আমি যেহেতু তার অধীনে চাকরি করি তাই ৫০টি চাবুকের ২০টি আমার হাতে মারা হোক।” আদেশ পালিত হলো, বিচারকের হাত থেকে রক্ত ঝরল।

এরপর তিনি বাকি ৩০টি চাবুক নগর প্রধান, খাদ্য গুদাম প্রধানদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন এবং সবাইকে ১০০ দিনার করে জরিমানা করলেন, এই বলে যে—”যে সমাজ একজন বৃদ্ধ মহিলাকে চোর বানায়… সে সমাজের সবাই অপরাধী।”
সংগৃহীত প্রায় ১০,০০০ দিনার থেকে সামান্য অংশ জরিমানা বাবদ রেখে, চুরি যাওয়া দোকানের মালিককে ক্ষতিপূরণ দিয়ে অবশিষ্ট ৮,৫০০ দিনার বৃদ্ধাকে ভরণপোষণের জন্য দান করা হলো। এবং শেষে খলিফার আসনে বসে বিচারক রূপে হারুন অর রশিদের ক্ষমা চাওয়ার মধ্য দিয়ে এই আখ্যান সমাপ্ত হয়।

বিচারকের আত্মাহুতি: প্রজ্ঞার অগ্নিপরীক্ষা

নিজের হাতে কুড়িটি চাবুক নেওয়ার সিদ্ধান্ত—এ যেন ক্ষমতার দম্ভ চূর্ণ করে দায়িত্ববোধের স্বর্ণমুদ্রা প্রতিষ্ঠা। বিচারকের করতল বেয়ে যখন রক্ত ঝরছিল, সেই রক্ত কেবল তাঁর নিজের যন্ত্রণার প্রতীক ছিল না, তা ছিল শাসকশ্রেণির দীর্ঘদিনের অবহেলা ও উদাসীনতার প্রায়শ্চিত্ত। এটি ছিল এক নীরব বার্তা—আইন ততক্ষণই জীবন্ত, যতক্ষণ তা মানুষের দুঃখ-কষ্টের শরিক হয়, দণ্ডগ্রহণের মাধ্যমে নিজেকে শুদ্ধ করে নেয়।
সামাজিক দায়বদ্ধতার শৃঙ্খল ও প্রায়শ্চিত্ত
: এরপর তিনি সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপর জারি করলেন সম্মিলিত অর্থদণ্ড… এই জরিমানা কেবল অর্থদণ্ড ছিল না, এটি ছিল সামাজিক চেতনার জাগরণ। বিচারক নিজের পকেট থেকে অর্থ দিয়ে সমাজের ব্যর্থতার দায়ভার গ্রহণ করলেন এবং এই সম্মিলিত অর্থভান্ডারটি অসহায় বৃদ্ধার হাতে তুলে দিলেন, যা ছিল শোষিত শ্রেণির প্রতি সমাজের নীরব ঋণ পরিশোধ।

ক্ষমা চাওয়ার মহিমা: হারুন অর রশিদের আত্মসমীক্ষা

: খলিফার এই বিনয়ী আচরণ প্রমাণ করে যে, তিনি কেবল ক্ষমতার আসনে বসে থাকা শাসক নন; তিনি একজন দায়িত্বশীল অভিভাবক, যিনি নিজের ভুল স্বীকার করে প্রজা অধিকারকে সর্বোচ্চে স্থান দেন। এই ক্ষমা চাওয়া ছিল কেবল এক বৃদ্ধার কাছে নয়, তা ছিল প্রজাসাধারণের প্রতি শাসনের আত্মসমীক্ষা…

উপসংহার

এই উপাখ্যান মানব সমাজকে এক শাশ্বত সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়: প্রকৃত বিচার তখনই সম্ভব, যখন শাসক নিজেকে নিয়মের ঊর্ধ্বে নয়, বরং নিয়মের প্রথম সেবক ও দায়িত্বশীল ধারক মনে করেন। বিচারকের চাবুক এবং খলিফার অশ্রু আমাদের শেখায়—আইনের প্রতি শ্রদ্ধা তখনই আসে, যখন আইন মানবিক হয়; আর শাসন তখনই সফল হয়, যখন শাসক আত্মোপলব্ধির আগুনে পুড়ে ন্যায়কে হৃদয়ের গভীরে প্রতিষ্ঠা করেন। এটি কেবল একটি গল্প নয়, এটি রাষ্ট্রনীতি ও মানবতাবাদের এক জ্যোতির্ময় দর্শন।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024 আমাদের চ্যানেল
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: CloudVai-ক্লাউড ভাই