1. admin@amaderchannel.online : admin :
  2. 2193wenona@powerscrews.com : rakib boss : rakib boss
  3. nnsabiha@gmail.com : SABIHA AKTER : SABIHA AKTER
রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:২৪ অপরাহ্ন
আজ ২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ১৬ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি , ৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

স্বাধীনতা: নিছক পতাকা নয়, অস্তিত্বের আকাশ ও নিরন্তর সাধনা — আশরাফুল আলম তাজ

  • Update Time : শনিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৫
  • ৩৫ Time View

 

  • স্বাধীনতা: নিছক পতাকা নয়, অস্তিত্বের আকাশ ও নিরন্তর সাধনা — আশরাফুল আলম তাজ

ভূমিকা: স্বাধীনতা—রাষ্ট্রের সৃষ্টি নয়, মানুষের নিজস্ব চেতনাবোধ
স্বাধীনতা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সনদপত্রের শীতল অক্ষর নয়; নয় কোনো মুদ্রিত অনুমতিপত্র, যা রাষ্ট্রের সীলমোহরে বৈধতা পায়। এ হলো মানবজন্মের প্রথম অনিবার্য নিশ্বাস—যা আপাতদৃষ্টিতে নিঃশব্দ, কিন্তু মানব ইতিহাসে তা মহাবিস্ফোরণের ন্যায় উত্তাল ও প্রলয়ংকরী। শিশুর প্রথম কান্নার মতো এতেই নিহিত থাকে এক স্বভাবজাত সার্বভৌমত্ব। স্বাধীনতার ভাষা কোনো শাসকের কলম থেকে নিঃসৃত হয় না, বরং জন্ম নেয় মানুষের অন্তঃস্থ উষ্ণ রক্তে, জীবনের অভ্যন্তরীণ অগ্নিপিণ্ডে।
রাষ্ট্র ও সমাজ সেই জন্মগত স্বাধীনতার একটি নির্মিত পরবর্তী রূপ—যেন নিরাবেগ যন্ত্রশিল্পী, যারা মানুষের উষ্ণ প্রাণবায়ুকে আইন ও বিধির শীতল জ্যামিতিতে বন্দী করতে সচেষ্ট। কিন্তু জন-স্বাধীনতা, ধূমকেতুর এক অনিবার্য আঘাতের ন্যায়, সেই জ্যামিতির দেয়ালকে চূর্ণ করে দেয় এক অগ্নিবীণার অনির্বাণ নিনাদে:
“আমি শুধুই ভোটের সংখ্যা নই; আমি আত্মা, আমি শব্দ, আমি মানুষ—আমি ক্ষমতার আঁকা নকশায় বন্দী থাকব না। আমার সত্তাই আমার সীমাহীন আকাশ।”

জাতিরাষ্ট্রের যে যান্ত্রিক ধারণা—যা ওয়েস্টফেলিয়ার শান্তিচুক্তির পর ইউরোপে কৃত্রিম ডানা পেয়েছিল—তা বাংলার বুক ছিঁড়ে রক্তের প্লাবন, ভাষার শপথ এবং মায়ের বুকের কান্নায় এক নতুন আধ্যাত্মিক তন্ত্রে পুনর্জন্ম নেয়। এই ইতিহাস আমাদের কানে ফিসফিস করে বলে: রাষ্ট্র জন্ম নেয় কৃত্রিম সীমান্তে, কিন্তু স্বাধীনতা জন্ম নেয় মানুষের অদম্য অন্তঃপ্রাণে।

১. ঐতিহাসিক উৎসমুখ: স্বাধীনতার উত্থান জনতার পথেই

১.১ ভাষা আন্দোলন (১৯৫২): শব্দের ক্যানভাসে রাষ্ট্রের আত্মা
ফেব্রুয়ারি ১৯৫২—এ কোনো পুষ্পাঞ্জলির মৃদু অর্ঘ্য ছিল না; এ ছিল শব্দের ক্যানভাসে খোদাই করা অস্তিত্বদর্শন। মায়ের ভাষার গর্ভে যারা নিহত হয়েছিলেন, তাঁরা বলেননি—”আমাকে হত্যা করো”। বরং তাঁদের রক্তক্ষরণ চিৎকার করে বলেছিল: “আমাকে অস্বীকার করো না।”
রাষ্ট্র যখন ভাষাকে হত্যা করে, তখন তা কেবল শব্দাবলীকে নয়, মানুষের সম্মিলিত মানচিত্রকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। মার্ক্সের আহ্বান যেন প্রতিধ্বনিত হয়: মুক্তি কেবল রাজনৈতিক শৃঙ্খল ভাঙা নয়; তা হলো সামাজিক দাসত্বের বিরুদ্ধে মানব-অস্তিত্বের আদিম উচ্চারণ। ভাষা আন্দোলন তাই কোনো প্রদীপের ক্ষীণ শিখা নয়—এ ছিল সংস্কৃতিগত দাসত্বের বিরুদ্ধে মানব-অস্তিত্বের এক চূড়ান্ত অগ্নি-বিদ্রোহ।
১.২ মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১): মানচিত্র নয়, আত্মমর্যাদার সংগ্রাম
১৯৭১—বাংলা মায়ের গভীর বুকে চাষ করা হয়েছিল একটিই বীজমন্ত্র: স্বাধীনতা। সেই মন্ত্রের প্রকম্পনে পৃথিবীর মন পাতার মতো কেঁপেছিল—কারণ যুদ্ধটি কোনো ভূখণ্ডের সীমানা দখলের জন্য ছিল না; এটি ছিল মানুষের আত্মমর্যাদার জন্য, রক্তে লেখা রাষ্ট্রাধিকারের জন্য এক মহাকাব্যিক সংগ্রাম।
রুশো বলেছিলেন, সামাজিক চুক্তি ব্যক্তিকে নিরাপত্তা দেয়। কিন্তু বাংলার মানুষ শিখেছিল: নিরাপত্তা তখনই অর্থবহ, যখন তা আত্মার মালিকানায় থাকে।
ভয়ের হিমঘরে যখন জনতা নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে, ক্ষমতার ছায়া তখন শিকারি নেকড়ের মতো নীরব হয়ে ওঠে—নিঃশব্দে গিলে নেয় জন অধিকার।

২. দার্শনিক কাঠামো: স্বতন্ত্রতা ও দায়বোধের দ্বৈত শিখর

২.১ লিবারাল স্বাধীনতা: ব্যক্তির শ্বাসরুদ্ধ হলে রাষ্ট্র মৃত
জন লক যেমন বলেছিলেন—স্বাধীনতা মানে আইনবিহীন অবাধ স্বেচ্ছাচার নয়; বরং এমন আইন, যা মানুষের উপর নয়, ক্ষমতার উপর প্রযোজ্য।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রশ্নটি হলো: আইন কি দুর্বলতম নাগরিককে রক্ষা করে, না কেবল ক্ষমতার গোলার্ধে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়? যদি সাংবাদিকের কলম ভয়ে কাঁপে, যদি কবির কবিতা সেন্সরের নখরে ছিন্ন হয়, তবে সংবিধানের পাতায় লেখা স্বাধীনতা কেবল উৎসবের আতশবাজি—যা মানুষের জীবনের অন্ধকারে মিটিমিটি জ্বলে নিভে যায়।
২.২ কমিউনিটেরিয়ান স্বাধীনতা: সমাজের দিকেও দায়
অমর্ত্য সেনের সেই জ্যোৎস্নাস্নাত ধারণা: উন্নয়ন কোনো সংখ্যাতত্ত্ব নয়; এটি মানুষের সম্ভাবনা বিস্তারের জ্যোৎস্না। যখন অর্থনৈতিক বঞ্চনা মানুষের কল্পনাকে শুষ্ক করে দেয়, যখন দুর্নীতি কৃষকের ঘামের উপর শকুনের মতো ভোজ দেয়, তখন রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা রূপান্তরিত হয়—মিথ্যা মুক্তির নতুন দাসত্বে।
স্বাধীনতা তখন নিছক সংবিধানের একটি অধ্যায় নয়; এটি মানুষের ক্ষুধা, ঘাম ও মর্যাদার সমান্তরাল একটি সেতু—যা প্রতিটি নাগরিকের জীবনকে ছুঁয়ে যায়।

৩. সাংবিধানিক আদল: প্রতিশ্রুতি ও জনগণের নজরদারি
সংবিধান হলো স্বাধীনতার প্রথম শিলালিপি—যেন মহাশ্মশানে খোদাই করা নিয়তির লিপি নয়—বরং মানুষের হৃদস্পন্দনের চুক্তিপত্র। ধারা ২৭ (সমতার অভিষেক), ধারা ৩৯ (মানুষের স্বরকে সিংহাসন), এবং ধারা ৩২ (জীবন ও নিরাপত্তার অবিচ্ছেদ্য আকাঙ্ক্ষা)—এগুলি কেবল প্রতিশ্রুতি নয়, এগুলি রাষ্ট্রকে দেওয়া জনতার পবিত্র আদেশ।
আইন যখন দুর্বলতমের পাশে এসে দাঁড়ায়—তা হলো ন্যায়। আইন যখন ক্ষমতাকে রক্ষা করে—তা নিপীড়নের শীতল প্রাসাদ।
যদি সংবিধান গোপনে কোনো স্বর্ণমৃগের মতো নাগরিক অধিকারকে বন্দী করে রাখে, তবে রাষ্ট্র পরিণত হয় ক্ষমতার মৌন গুহায়—যেখানে স্বাধীনতা এক শোকের ফেরিওয়ালা মাত্র।

৪. অর্থনৈতিক স্বাধীনতা: দেহে ক্ষুধা—মনে স্বাধীনতা?

স্বাধীনতা শুধু একটি পাসপোর্ট বা উড়ন্ত পতাকা নয়; এটি ক্ষুধার থালা, কর্মের মর্যাদা, এবং শান্ত ঘুমের নিশ্চয়তা। যে শ্রমিক দিনের শেষে কেবল হাড়ভাঙা ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফেরে, যে মা সন্তানের দুধের জন্য ব্যাংকের ঋণে ডুবে, তাদের কাছে স্বাধীনতা—একটি ক্যালেন্ডারের তারিখ; জীবনের বাস্তবতা নয়।
অর্থনৈতিক অসমতা তখন হয়ে ওঠে এক অদৃশ্য কারাগারের ফাঁদ—যেখানে মানুষ আইনত স্বাধীন, কিন্তু কার্যত পরাজিত।

৫. নির্বাচন ও গণ আন্দোলন: ইতিহাসের শ্বাস-প্রশ্বাস
গণতন্ত্র কি নিছক একটি ‘অনুষ্ঠান’, নাকি একটি ‘অধিকার’?
গণতন্ত্র হলো নৈতিকতার এক পবিত্র লেনদেন। ভোটের দিনে রাষ্ট্র নীরব থাকে; জনগণ তখন তার ঈশ্বরীয় ভাষায় কথা বলে। কিন্তু ব্যালট যখন ক্ষমতার ঠিকানায় পৌঁছানোর আগেই কোনো অদৃশ্য হাতের বন্ধনে বিকৃত হয়ে যায়, তখন নির্বাচন আর অধিকার থাকে না—হয়ে ওঠে এক অভিনয়ের আলোকসজ্জা।
গণ আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ শিক্ষা
স্বাধীনতা কখনও শাসকের দয়া নয়; এটি জনতার সম্মিলিত ইচ্ছার উত্তপ্ত অগ্নিশিখা।
রাস্তার ধুলো তখন ইতিহাসের গ্রন্থ হয়ে ওঠে—প্ল্যাকার্ড হয় নাগরিকের কবিতা, আর নীরবতা হয়ে ওঠে বিপ্লবের প্রথম, অনিবার্য পদচিহ্ন।

৬. জন/গণ স্বাধীনতার প্রকৃত পরিসীমা
স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় তখন—যখন ভিন্নমত রাষ্ট্রদ্রোহ নয়, বরং রাষ্ট্রের প্রতি সর্বোচ্চ উপদেশ। যখন বিচারকের চোখ অন্ধ, কিন্তু ক্ষমতার প্রতি নয়, শুধু ন্যায়ের প্রতি। যখন আইন শাসকের ইচ্ছার দাস নয়, ন্যায়ের কাছে মস্তক নত। যখন অর্থনীতি মানুষকে মুক্তির রুটি দেয়, মুনাফার দাসত্ব নয়।

উপসংহার: স্বাধীনতা—অস্তিত্বের আকাশ
জন-স্বাধীনতা রাষ্ট্রের অনুগ্রহ নয়; এটি মানুষের জন্মগত অস্তিত্বের আকাশ—যেখানে প্রত্যেকটি মনোজগত একটি পৃথক নক্ষত্র। রাষ্ট্রের পবিত্রতম দায়িত্ব হলো এই আকাশকে রক্ষা করা, ন্যায়, মর্যাদা ও মানবিকতার একচ্ছত্র মহাজাগতিক নিয়মে।
নাগরিকের চিরন্তন দায়িত্ব হলো—নিজের স্বাধীনতার শত্রুকে চিহ্নিত করা, আর মানবিক সাহসে তার বিরুদ্ধে উচ্চকিত হওয়া।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা তাই কেবল পতাকার রঙ নয়—এটি ইতিহাসের নদী, মানুষের গর্জন,গ আর ভাষার মন্দির। যে দিন রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, সেই দিন জনতা রাজপথকে পাণ্ডুলিপি বানায়; কারণ—
স্বাধীনতা হলো সময়ের বুক থেকে হারিয়ে যাওয়া অক্ষরগুলিকে পুনর্লিখনের এক অনির্বাণ, চিরন্তন দায়িত্ব।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024 আমাদের চ্যানেল
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: CloudVai-ক্লাউড ভাই